চট্টগ্রামের দক্ষিনের উপজেলা লোহাগাড়ায় সামাজিক রীতি-নীতি সহজ সরল ও সহজবোধ্য। আধুনিককালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এর রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। প্রথাগত সামাজিকতা এখন বিলুপ্ত হয়নি। নানা ধর্মের লোকের বসবাসের ফলে এ জনপদে সামাজিকিকরন হয়েছে সহজে।
লোহাগাড়ায় প্রাতঃস্বরণীয় তান্ত্রিক মগধেশ্বরী সাধক
বিস্ময়কর যাদুকর প্রয়াত ধীরেন্দ্র নাথ।
চট্টগ্রাম লোহাগাড়া উপজেলাধীন বড়হাতিয়ার খ্যাতিমান তান্ত্রিক প্রয়াত ঈশান চন্দ্র নাথ কারিগর এর সাত সন্তানের ৪র্থ সন্তান প্রয়াত ধীরেন্দ্র নাথ বৈদ্য। অভাবী পরিবারের পরিশ্রমী সন্তান ঈশান চন্দ্রের অভাব-অনাটনে পরিবার চলছিল না বলেই একদিন ভাগ্যন্বেষনে বাড়ী থেকে বের হয়ে দক্ষিনে মুংডু, ভুচিদং, আকিয়াব, রেঙ্গুন, শ্যাম-কামরূপ কামাক্ষ্যা সহ বহু দেশ ঘুরে জীবন বাজি রেখে নিজেকে দশ জনের মতো প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। প্রায় ২৪ বছর সময় জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পর স্বর্ণের, রৌপ্যের, কামার, কুমার, ঠাটারী, সুতার, রাজের ও তাঁতের কাজ সহ আরও অনেক কাজে নিজেকে নিবেদন করেন। যার মধ্যে তন্ত্র-মন্ত্র ও ঝাড়-ফুক ছিল অন্যতম। পরে নাড়ীর টানে জন্মভূমিতে ফিরে আসার পর জিন্দাঅলি পেঠান শাহ্ (রহঃ) ফকিরের ইশারায় তিনি বৈবাহিক জীবনে পদার্পন করেন। দৈন্যতায় ভরা ছিল ঈশান চন্দ্রের গোটা পরিবার। ঈশান কবিরাজ তাঁর ছেলে ধীরেন্দ্রের গতিবিধি লক্ষ্য করে তাকে উচ্চ শিক্ষায় মনোনিবেশ না করে সমাজের হিতার্থে লাগিয়ে তাঁর জীবনের অর্জিত সকল প্রতিভা তাকে দিয়ে কাজে লাগাতে শুরু করলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরেন্দ্র বৈদ্য নিজে হয়ে উঠেন অসাধারণ দিগ বিজয়ী তান্ত্রিক চিকিৎসক। শুরু হলো যাদু-টোনা, সাপে কাটা রোগী, কালা জ্বর শান্নিপাতিক, জীন-আছর, পরী-দেবতায় পাওয়া, থেকে আরম্ভ করে সকল প্রকার আধ্যাত্মিক চিকিৎসা। উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা হচ্ছে, মা মগধেশ্বরী দেবীর হাট বসা, তপসী গাছাকে পিটিয়ে মগীনী ডাল গাওয়া গান করার মধ্যে দিয়ে। একদিন হঠাৎ করে এই ধীরেন্দ্র বৈদ্য মা মগধেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ প্রাপ্ত হন। তিনি তার বাবার রেখে যাওয়া ভগ্নদশাগ্রস্থ সেবাখোলাকে মা মগধেশ্বরী মন্দির নির্মাণ করে স্বয়ং দেবী মগধেশ্বরী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। যেটি দক্ষিণ রাজ্যেও মগ কর্তৃক খননকৃত ঐতিহাসিক মগদিঘীর উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে বিদ্যমান পৌনে দু’শ বছরের কালের স্বাক্ষী মন্দির আঙ্গিনায় অশ্বথ্ব ও বটবৃক্ষ। মন্দিরকে ঘিরে অনেক ইতিহাস রয়েছে যা শতোর্ধ বয়সের ব্যক্তি ছাড়া কেউ জানবে না। এলাকার প্রবীণরা জানালেন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের অনেক তথ্য বহুল ইতিহাস। জানা যায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক মন্দিরের আশে পাশে বসবাস করলেও বসতি স্থাপনা ছিল ফাঁকা ফাঁকা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা মা মগধেশ্বরী পূজা পার্বন করতেন। জনশ্রুতিতে আছে, কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি ক্রিয়া কর্মাদি ও পূজা অর্চ্চনার অগের দিন মা মগধেশ্বরীর নামে পূজা দিয়ে একমনে যদি চাইতো, অনুষ্ঠানে যা থালা-বাসন ঘটি-বাটি লাগবে তা নৌকাযোগে মগদীঘিতে কিনারায় ভেসে আসতো। পরদিন পুনরায় দ্রব্যাদি নিয়ে পানির ধারে দাঁড়ালেই নৌকা এসে সব নিয়ে গিয়ে মাঝ দিঘীতে গিয়ে ডুবে যেতো। তাই ভয়ভীতিতে কেউ দিঘীতে হাটু পরিমাণ পানিতেও নামতো না। ঐ কিংবদন্তীর ঘটনা এখনও প্রবীণদের মুখে শুনা যায়।
একদা মন্দির সংলগ্ন মধু ব্রাহ্মন পরিবারে অনুষ্ঠান সেরে পরদিন লোভে পড়ে একটি বাটি রেখে দিলে আর থালা বাসন ভেসে আসে না। ঐ পরিবার ক্রমান্বয়ে ধবংস হয়ে যায়। তৎকালীন দৈবিক নাম যৈক্ষ্য ও বিভিন্ন অপদেবতা রাত্রে দিঘীর চারপাশে ঘোরা ফেরা করতো। অনেকেই দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেহুশ হয়ে মারাও গেছেন যা এলাকার সর্বজন জ্ঞাত। প্রখ্যাত তান্ত্রিক ও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি ধীরেন্দ্র বৈদ্য মানুষের মঙ্গল ও রোগ নিরাময়ের জন্য মন্ত্রশক্তির বদৌলতে গৃহ শান্তি, গর্ভবতীর সহজ প্রসব প্রশান্তি, জ্যোতিষ বিদ্যা, গৃহশান্তি করে চলতেন। হঠাৎ একদিন চিন্তা করলেন জনশূন্য অবস্থায় মাকে একা রাখা ভাল হচ্ছে না ভেবে অনতিদূরে ক্ষয়ে যাওয়া শ্রী শ্রী কালী হাটকে ভেঙ্গে এনে মগদিঘী এলাকায় দিনে দিনে যাদু-মন্ত্র, ম্যাজিক শো (তুমব্রু খেলা) আয়োজন করে বাজার বসিয়ে দিয়ে ছিলেন। যার নাম এখন মগদিঘীর বাজার নামে খ্যাত। সেই থেকে আস্তে আস্তে মানুষ বিভিন্ন পূজা-অর্চ্চনা-মানত করে এই মা’র মন্দিরের শ্রী বৃদ্ধি করতে অনুপ্রাণিত হতে লাগলেন।
প্রয়াত ধীরেন্দ্র বৈদ্য মা মগধেশ্বরীর সাধক বলে এক পুরিয়া ঔয়ধ দিয়ে মানুষের সর্দ্দি, কাশি, গলাফুলা, দাঁতের সান্নিক ও কালাজ্বর উপশম করতো। আছরে পাওয়া গর্ভবতীদের অকাল বাচ্চা নাশ, মানুষে মানুষে বান টোনা মেরে ক্ষতিসাধন করা থেকে নিমিষেই মুক্তি পেয়েছে যাহা অন্ততপক্ষে দক্ষিণ জেলায় সু-প্রসিদ্ধ ছিল। অসম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী, এই ধীরেন্দ্র বৈদ্য এলাকায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। একদিন পটিয়ার মনসার টেক নামক জায়গায় আবদুল মোনাফ সওদাগর নামে চট্টগ্রাম রেয়াজুদ্দিন বাজারের খ্যাতিমান ব্যবসায়ীকে চিকিৎসা শেষে বাড়ী ফেরার পথে দেখতে পায় একজন লোককে সাপে কেটে রীতিমত দাফনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, এই ঘটনা দেখে থমকে দাঁড়ায়। ওনার অনুরোধে কাফন পড়া মুর্দাকে নামিয়ে কাফন খুলে পাকা ৩ ঘন্টা তান্ত্রিক চিকিৎসা দেওয়ার পর ঐ লোকের জীবন ফিরে পেয়ে ছিলো, যার প্রমাণ এখনও স্বাক্ষী হয়ে আছে মনসার টেক নামক জায়গায়। পর পর দীর্ঘ দিন ভোগা যাদু টোনার রোগী বোচন সওদাগর, রহিম বকসু ও স্থানীয় চুনতির বিবি ছগিরা খাতুনকে আছরে পেয়ে অকাল সন্তান প্রসব করে তিন সন্তান নষ্ট হওয়ার পর তাবিজ দিয়ে বংশ রক্ষা করেছিলেন যা এখনও প্রমাণ রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ছিদ্দিক মিয়ার বলি খেলায় একজন লোকের তিন মাথা, ছয় মাথা, ৪ হাত, ৪ পা, একজনের দুই পেট, ১২ মাথা ১০ হাত ইত্যাদি যাদু দেখিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যা এখনও প্রতিটি মানুষের হৃদয় পটে স্মৃতি হয়ে আছে। এই যাদুখেলা ও ম্যাজিক শো নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি পুরো টিম নিয়ে চলে যেতেন এবং সুনামের সহিত বাড়ি ফিরতেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মহেশখালীর আদিনাথের মেলা, বাঁশখালীর ঋষিকুম্ভের মেলা, চকরিয়ার ঘোরদৌড় মেলা, ১লা বৈশাখ তপসীগাছার ক্ষেত্রপাল মেলা, সাতকানিয়ার মক্কার খেলা ইত্যাদি। ঐসব মেলা খেলায় উৎসুক জনতা অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকতো ধীরেন্দ্র বৈদ্যের মানুষ কাটা যাদুর খেলা কখন আসবে। এলাকার গণ্যমান্য ও সরকারী অফিসার অবধি তাঁর দেখে বিষ্মিত হতো। বলার অবকাশ থাকে না অপূর্ব স্মৃতির কথা। বানটোনা করে মানুষের ক্ষয় ক্ষতির প্রতিকার করার একমাত্র তান্ত্রিক ধীরেন্দ্র বৈদ্য বললেই চলে।
কক্সবাজারে অবস্থিত ভোলাবাবুর পেট্রোল পাম্প, সেই ঢেমশার ভোলা বাবুকে যাদু-টোনার কবল থেকে রক্ষা করে ছিলো এই ধীরেন্দ্র বৈদ্য। এই মহাতান্ত্রিক সাধক মা মগধেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা, চেতনা ও মন্ত্র-তন্ত্র চিকিৎসার উন্নতি। ঈশান চন্দ্রের চার ছেলের মধ্যে সকলের বড় ধীরেন্দ্র বৈদ্য। শ্যামা কামাক্ষ্যা থেকে সাধক লব্ধ যে জ্ঞান, তার সিংহ ভাগ দিয়ে গিয়ে ছিলো ধীরেন্দ্রকে। তিনি দীর্ঘ দিন মানুষের হিতকর্মে নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। পরেও তাঁর আশির্বাদ পুষ্ট হয়েছিলেন যে কয়জন শিষ্য সাগরেদ তাঁর মধ্যে আমতলীর ইয়াছিন পাড়ার প্রয়াত আমীর হোসেন মৌলভী, ছদাহার শ্যামা জলদাশ, উজির ভিটার নূর আহমদ বৈদ্য, মছদিয়ার বীরেন্দ্র বড়ুয়া (গাছা) উল্লেখযোগ্য। তিনি সফল তান্ত্রিক সাধক হিসাবে যাকে সহযোগী করে এতটা বড় বড় যাদু-টোনার রোগীর চিকিৎসা করে ছিলেন সেই হচ্ছে- আধুনগরের তপসী গাছা। ঐ গাছা স্বয়ং মা মগদেশ্বরীকে হাজির করতে সক্ষম হতেন। তাঁরই বাণী দিয়েই ধীরেন্দ্র বৈদ্য রোগের চিকিৎসা করতেন। বর্তমান প্রকৃত ঝাড়-ফুঁক, যাদু-টোনার কোন ভাল তান্ত্রিক চিকিৎসক না থাকাতে সুবিধা বঞ্চিত অনেক গ্রামে-গঞ্জে বিনা চিকিৎসায় কালে-আছরে পাওয়া, গর্ভবতী মা সন্তান হারা সহ জীবন হারাচেছ। সাপে কাটা রোগী, যাদু টোনার রোগীর কোন ভাল প্রতিকার নাই বললেও চলে। এই মুহুর্তে প্রয়োজন ছিল প্রয়াত ধীরেন্দ্র বৈদ্যের। ওনারই প্রতিষ্ঠিত মা মগধেশ্বরী মন্দিরে এখন বহুমুখী জনহিতকর প্রকল্প সহ পাশা পাশি অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠান বেগবান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে মন্দিরে দেবী পূজা, দিঘীতে পূণ্য স্নান, প্রতিষ্ঠা উৎসব, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম জয়ন্তী ও তিরোধান স্মরনানুষ্ঠান, শ্রীমৎ জ্যোতিষানন্দপুরীর জন্মতিথী উৎযাপন, গীতা শিক্ষা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, কৃতি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, শীতবস্ত্র বিতরণসহ, বিভিন্ন মাঙ্গলিক ও মহতী কর্মসূচী বছরের বিভিন্ন সময়ে বর্ণাঢ্যভাবে উৎযাপিত হয়। সেখানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ও হাজারো ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে। ধীরেন্দ্র বৈদ্য দানশীল, পরহিতৈষী ও একজন সাদামনের মানুষ ছিলেন। তিনি ১৯৮৯ ইংরেজীতে পরলোক গমন করেন। এ সাধক আজীবন তার কর্মে প্রাতঃস্বরনীয় হয়ে থাকবেন। ভক্ত ও এলাকার সুধীবৃন্দ তার প্রতিষ্ঠিত মন্দির প্রাঙ্গনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনটাই অভিমত রাখেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস